দিন চারেকের ভ্রমণ শেষে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসার সময় শূন্য
ঘরের দিকে চেয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিল। মেয়েকে বলি, দেখ দুদিনের জন্য আসা, তবু
কোথায় যেন মায়া পড়ে যায়। সেও সায় দেয় আমার কথায়।
অমন আমার প্রত্যেকবার হয়, যখনই কয়েকদিন একই হোটেলের ঘর ছেড়ে
অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য রওনা দিই। তা লেহ্-র সেই ফ্রি আপেলের হোটেল হোক কী
আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারের অথবা সদ্য ফেলে আসা পুরী। আমার জীবনের ওই যে কয়েকটা
মুহূর্ত রয়ে গেল ওই ঘরে, বারান্দায়, নীচের খাওয়ার ঘরে, ম্যানেজার কী রান্নার
ঠাকুরের সঙ্গে গল্পে, দরজা পেরিয়ে গলিটায় পড়েই ডানহাতের চায়ের দোকানে, আরও এগিয়ে
সমুদ্রের বেলাভূমি শুরু হওয়ার আগেই ডাবের দোকানটার বেঞ্চিটায়, বেলাভূমি ধরে আরও এগিয়ে
সমুদ্রের ধারের সারি সারি পাতা চেয়ারে, সাগরের জলে ভেজা বালিতে, রাতের অন্ধকারে
ভেসে আসা সাদা রঙের ফেনায় আর বাতাসের নোনা গন্ধে। ওই যে স্বর্গদ্বারে শ্মশানে
চিতার ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল, ওরই পাশ দিয়ে গলির পথে, সমুদ্রের ধারের দোকানগুলোয়,
জগন্নাথের মন্দিরের ভেতরে দাঁড়িয়ে কোণার্কের স্থাপত্যের সঙ্গে তুলনা করছিলাম যখন,
চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের বয়স্ক গাইডটির কাছে যখন তৃতীয়বার মূর্তিগুলোর নাম
শুনছিলাম আর এত ছোট পরিসরে মুক্ত আকাশের নীচে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে অদ্ভুত এই মন্দির-মূর্তি
আর ঠিক তার আগে ধৌলিতে অশোকের শিলালিপি দেখে আমার স্বভাবগতভাবে যথারীতি আশ্চর্য
হচ্ছিলাম, অবাক হচ্ছিলাম রঘুরাজপুরের শিল্পীদের কুশলতায় আর পিপলির ঝলমলে সব হাতের
কাজে - আমার সেইসব মুহূর্তগুলো যে রয়ে গেল ওইখানের মায়ায়।
যাওয়ার সময় দেহখানাও রেখে যেতে হবে। অথচ কত মায়া! মায়ার
কোনও নারী-পুরুষ ভেদ নেই, দেশ, জাতি, ধর্ম কিচ্ছু নেই। আছে শুধু বড় অদ্ভুত এক
অনুভব। কারোর বা মায়া তার চৌহদ্দিটুকুর মধ্যেই আর কারোর মায়া সারা পৃথিবীর
ধূলিকণা, মানুষজন, পশুপাখির প্রতি। কুয়াশামাখা ভোরের একটা মায়া আছে, যেমন আছে শীতের
শেষ বিকেলের রোদের অথবা বৃষ্টি শেষের ভেজা মাটির সুবাসে। কোনও কোনও মানুষের চোখের
তারাতেও অদ্ভুত এক মায়া থাকে। মায়া থাকে গাছের পাতার সবুজে আর তার বুনোগন্ধে।
আমার মেয়ে কলকাতার থেকে অজন্তা-রাজস্থান সর্বত্র রাস্তার
কুকুরের গায়ে-মাথায় হাত বোলায়। ছানা দেখলে, মা না বকলেই কোলে তুলে নেয়। পুরীর সমুদ্রের তীরে এন্টারটেনমেন্টের জন্য যে উট
নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মালিকেরা, তাদের মুখ কেন পুরো আটকে দেওয়া সেই নিয়ে খুব রেগে গেছে
সে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, উট নাকি কামড়ায়! কিন্তু রাজস্থান থেকে লাদাখ কোথাও
উটের এমন দশা দেখিনি। খামোখা পুরীর উটেরা কেন কামড়াবে আমাদের মাথায় কিছুতেই ঢুকল
না!
ফিরে এসে ঘরে বসে শুনি পাড়ায় দোল খেলার হইচই।
গত প্রায় দশ বছরেও এর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ তৈরি হয়নি। পুজো
হয়, দোল হয়, মাঝে মাঝে ফাংশানও হয়। পাড়ার পুরোনো মানুষজনের পরস্পরের মধ্যে খুব
ভালো মেলামেশা। আমাদেরও ডেকেছেন। কিন্তু আমি কখনও কোথাও মিশতে পারি না বা পারিনি
আমার বসবাসের চৌহদ্দিতে।
বোধহয় পথেই আমার মায়া।
বাড়ি ফিরে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে গিয়ে মনে হল, এই যে
এতগুলো সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে বোমায় ছিন্নভিন্ন করে দিল, যারা মারল আর যাদেরকে
মারল তাদের মধ্যে এই মৃত্যুটুকু ছাড়া কোনদিন কোনও বিদ্বেষের সম্পর্ক ছিল না।
ভালোবাসার সম্পর্কও ছিল না ঠিক।
কিন্তু এতগুলো মানুষকে নির্দ্বিধায় মারতে একটুও কি মায়া হল
না ওদের? ওরাও যে মানুষ ছিল।
আর এইসব লিখতে লিখতেই বীরেনরা সদলবলে আবির নিয়ে হাজির।
এবার রঙের মায়ায়...
No comments:
Post a Comment