আসলে
শব্দ ছাড়া কিচ্ছু প্রায় নেই। এই প্রায় শব্দটা বোধহয় খিদে শব্দটার জন্যই। শব্দ আছে
বলেই তোমার-আমার দেশ আছে ধর্ম আছে পতাকা আছে পার্টি আছে ভোট আছে চুরি আছে ডাকাতি
আছে ঘুষ আছে গণহত্যা আছে ধর্ষণ আছে রাজনীতি আছে আত্মহত্যা আছে যুদ্ধ আছে ভালোবাসা
আছে ঘৃণা আছে যৌনতা আছে। অথবা কিচ্ছু নেই। কারণ কিছু কিছু মানুষের এর কোনটাই থাকে
না। যাদের জন্য মানুষ শব্দ ব্যবহৃত হয়না বলেই মানুষ হয়ে ওঠে তারা। অথবা কিছুই
হয়না। মাথার ওপর পাখা ঘোরে বাতাসে শব্দের আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছেলেবেলায় জানলার ধারে
কান পাতলে রেলগাড়ির চাকায় সব কথা সব শব্দ সব গান শোনা যেত। সেই কবে স্কুলে পড়তে
ফিজিক্সের মাস্টারমশাই টিউনিং ফর্কে আওয়াজ তুলে শব্দের বিজ্ঞান বোঝাতেন। সেদিন
আমার মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে খুব রেগে বলল, ওদের স্কুলের ছেলেদের বিভাগটা নাকি নাম ডোবাবে।
কীরকম জিজ্ঞাসা করতে জানায়, স্কুল থেকে কোথায় একটা নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে অন্য সব
স্কুল সব প্রশ্নের কেমন চমৎকার উত্তর দিয়েছে আর যেই না ওদের ছেলেদের জিজ্ঞাসা করা
যে শব্দ কী করে হয়, একজন সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে তালি বাজিয়ে বলেছে, ‘এইভাবে’। আমি শব্দ করে হেসে বলি,
এক্কেবারে ঠিক বলেছে তো।
শব্দ
নিয়ে ভাবতে গেলেও সেই রবি ঠাকুরকেই মনে পড়ে যায় আবারও। সেই যে ‘আমি’ কবিতার শেষে বলেছিলেন, “তখন দূরে দূরান্তে অনন্ত
অসংখ্য লোকে লোকান্তরে এ বাণী ধ্বনিত হবে না কোনখানেই”। সেই আর কী আমি যদি নাই
থাকলাম, হাততালিটা দেবে কে? কিন্তু এদিকে মানুষে মানুষে ছুড়ি-বোমার শব্দের
প্রতিধ্বনিতে মানুষ শব্দটা টুকরো টুকরো থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বহু শতাব্দী প্রাচীন
চিত্রের মত বেমালুম নেই হয়ে যাচ্ছে। অজন্তার ক্ষয়ে যাওয়া বোবা অথচ গল্প বলা
ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ালে কেমন অতীত আর অনিবার্য ভবিষ্যত একসঙ্গে ফুটে ওঠে চোখের
সামনে। আরও একশো-দেড়শো বছর পর শূন্য গুহাগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর এই
শব্দময় পৃথিবীতে শব্দ আরও শব্দ জমতে জমতে আমরা কবে একদিন নিঃশব্দ হয়ে যাব।
হয়ত
সেদিনও কোথাও টিনের চালে বৃষ্টি পড়বে।
কিন্তু সেদিন
আর কারো খিদে পাবে না। অথবা কবিতা লেখা হবে না।
No comments:
Post a Comment