প্রুফ জমা দিয়ে বেশ হাল্কা মেজাজে বাসে উঠেছি। খানিকবাদে এক
লজেন্সওলা উঠে হাঁক পাড়ল – দই লজেন্স...।
যেকোনোরকমের মিস্টিই আমার চিরকাল প্রিয়। আমাদের ছোটবেলায়
মফঃস্বল শহরে শুধুমাত্র বিয়েবাড়িতে খাবার শেষ পাতে বড় মাটির হাঁড়ি থেকে হাতায় কেটে
কেটে মিস্টি লাল দই দিত। খুব কমই নেমতন্ন খেয়েছি। কিন্তু নিমন্ত্রণ হলেই আমার
সমস্ত মনপ্রাণ মাছ, মাংস পেরিয়ে ওই দইতে গিয়ে পড়ত। বড় হয়ে কলকাতায় হস্টেলে পড়তে
জলখাবারের পয়সাই থাকত না, তাই দই-মিস্টি খাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কলকাতায় পাকাপাকি
থাকার পর যদিবা খেতে শুরু করলাম তো আবার তা বারণের লিস্টিতে পড়ে গেল কিছুদিনের
মধ্যেই। অতএব টক দই-ই সই। আগে খাইনি, তাই ‘দই
লজেন্স’ হাঁক শুনেই কিনে ফেলি দুটাকায়
চারটে। একটা গালে দিয়ে দেখি বেশ খেতে, একেবারে কলকাতার মিস্টি দই।
লিচু লজেন্স খেতে আমার বেশ ভালোলাগে আর অরেঞ্জ লজেন্স। এই
অরেঞ্জ লজেন্স খেলেই ছোটবেলার কথা মনে হয়, আর এক্লেয়ার্স। ছোট ছোট গোল গোল কমলা
রঙের লজেন্স, কমলা মোড়কে। আর এক্লেয়ার্স-এর ওপরের আঠালো কঠিন চকলেট রঙের ত্বকের
ভেতরে যেন গলানো চকলেটের স্বাদ। চকলেট আমার খুব প্রিয়। কিন্তু একেবারে ছোটবেলায়
ফাইভ স্টার ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যেত না। ডাবড় মোড়ে সুভাষদাদার স্টেসনারি দোকানে
গেলেই তাই মায়ের কাছে আমার বায়না ছিল এক্লেয়ার্স নয় ফাইভ স্টার। ডেয়ারি মিল্ক
মফঃস্বলের বাজারে আসতে আসতে বেশ কিছুটা বড়ই হয়ে গেছি।
দই, মিস্টি, চকলেটের মতোই আইসক্রিম আমার প্রিয়। এখন তো কতরকমের আইসক্রিম পাওয়া যায়, কোনটা বেশি ভালোলাগে বলাই মুশকিল, অথবা সবই প্রায় ভালোলাগে, খাই বা না খাই। ছোটবেলায় রোজ ছুটির সময় স্কুলের দরজার কাছে আইসক্রিমওলা দাঁড়িয়ে থাকত। বাসভাড়ার
পয়সা বাঁচিয়ে আইসক্রিম খাওয়া। দশ পয়সায় অরেঞ্জ কাঠি আইসক্রিম মানে কমলা রঙের দেখতে
কমলালেবুর গন্ধওলা বরফ। এখন যে আইসক্রিমের দাম দশ টাকা। পঁচিশ পয়সাতে চকলেটের
গন্ধওলা কাঠি আইসক্রিম। পঞ্চাশ পয়সায় পাওয়া যেত চিঁড়ে আইসক্রিম। ওপরে চিঁড়ে দেওয়া
আর তার ভেতরটা খানিক ক্ষীরের মত স্বাদ। এটাও কিন্তু কাঠি আইসক্রিমই। এই আইসক্রিম
আর পরে কখনও কোথাও আমি দেখিনি।
স্কুলের সামনে আইসক্রিমওলাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ভারী মজার একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল। আমার মেয়ের স্কুল জি ডি বিড়লায় রোজ ছুটির সময় প্রথমে স্কুল বাসগুলো এক এক করে বেরোয়। আর আইসক্রিম নিয়ে রেডি থাকে স্কুলের সামনের আইসক্রিমওলা। বাসের জানলা থেকে হাত বেরিয়ে আসে, কারো দুটো আঙুল, কারও বা পাঁচটা কী তারও বেশি, তার সঙ্গে চিৎকার, কাকু দুটো, কাকু চারটে, কাকু দশটা। কাকুও দিব্বি নিপুণতায় প্রায় ক্রিকেট খেলার স্পিডে জানলার বাড়ানো হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে হাত থেকে দামের টাকাটা নিয়ে নেন। সেই কমলা রঙের কাঠি আইসক্রিম। কেউ চকলেট আইসক্রিম খেলে আলাদা করে 'চকলেট' বলে চিৎকার করে। মাঝে মাঝে একেকটা বাস মিস হয়ে যায় কাকুর। 'কাকু, কাকু, আইসক্রিম...' আশাভঙ্গের সুর ভেসে আসে কচি গলায়।
স্কুলের সামনে আইসক্রিমওলাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ভারী মজার একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল। আমার মেয়ের স্কুল জি ডি বিড়লায় রোজ ছুটির সময় প্রথমে স্কুল বাসগুলো এক এক করে বেরোয়। আর আইসক্রিম নিয়ে রেডি থাকে স্কুলের সামনের আইসক্রিমওলা। বাসের জানলা থেকে হাত বেরিয়ে আসে, কারো দুটো আঙুল, কারও বা পাঁচটা কী তারও বেশি, তার সঙ্গে চিৎকার, কাকু দুটো, কাকু চারটে, কাকু দশটা। কাকুও দিব্বি নিপুণতায় প্রায় ক্রিকেট খেলার স্পিডে জানলার বাড়ানো হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে হাত থেকে দামের টাকাটা নিয়ে নেন। সেই কমলা রঙের কাঠি আইসক্রিম। কেউ চকলেট আইসক্রিম খেলে আলাদা করে 'চকলেট' বলে চিৎকার করে। মাঝে মাঝে একেকটা বাস মিস হয়ে যায় কাকুর। 'কাকু, কাকু, আইসক্রিম...' আশাভঙ্গের সুর ভেসে আসে কচি গলায়।
আমাদের ছোটবেলায় ওই অঞ্চলে একটিমাত্র মিস্টির দোকান ছিল,
স্টেশনের কাছে, রেললাইনের ধারে। দোকানটায় রসগোল্লা ভালো করত। পরে ডাবর মোড়ে একাধিক
মিস্টির দোকান হয়েছিল, যারমধ্যে কল্যাণেশ্বরী মিস্টান্ন ভান্ডারই পুরোনো। এদের
দোকানের ল্যাংচা আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু এত বছর পর গিয়ে দুদিন ধরে তাক করেও
ল্যাংচা পাইনি। পরে একটা দোকান হয়েছিল মোড়ের থেকে কিছুটা ভিতরে, তাদের দই খুব ভালো
ছিল। এবারে একটা নতুন দোকানের মিস্টি আর দই খেলাম, বেশ ভালোলাগল। এই দোকানটা অবশ্য
অনেকটা ভেতরে।
কলকাতায় হেদুয়া চত্ত্বরে আমি অনেকদিন থেকেছি। কিন্তু
সেইসময়ে নকুড়ের মিস্টি কমই খেয়েছি। বরং এখন কখনও ওদিকে গেলে কিনে আনি। তবে নকুড়ের
মিস্টি আমার সবথেকে ভালোলেগেছিল আন্দামানে নৌকায় বসে বীরেনরা যখন ঝুলি থেকে বার
করে দিচ্ছিল – কড়াপাকের সন্দেশ।
কড়াপাকের সন্দেশ জিনিসটা আমার খুব ভালোলাগে। ওপরটা শক্ত কিন্তু চাপ দিলেই ভেতরটা রসে
কী গুড়ে ভরা। আন্দামানে একটা খুব সুন্দর মিস্টি খেয়েছিলাম, খানিক কেক ধরণের, খুব
হাল্কা আর ওপরে নারকোলের পাতলা পরত।
চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লাও খুব ভালোলাগে। তবে অমৃত-র দইয়ের যত
নাম, খেতে আমার তেমন আহামরি কিছু লাগেনি। আমাদের পাড়ার নিতাই সুইটস-এর দই বরং চেয়ে
চেয়ে খাওয়ার মতো। নিতাই সুইটস-এর বিভিন্ন মিস্টিই খেতে খুব ভালো। আমার সবথেকে
প্রিয় কালোজাম। কালোজাম মিস্টিটা কিন্তু সবাই খুব ঠিকঠাক বানাতে পারেনা। ওপরটা
কুচকুচে কালো, খানিক প্রায় পোড়া ধরণের। কামড় দিলে ভেতরটা হালকা গোলাপী আর রসে ভরা।
ওরই মধ্যে একটা এলাচের দানা, মুখে পড়লেই স্বাদ বদলে যাবে।
ইদানীং চকলেট মিস্টির বেশ চল হয়েছে। চকলেট মিস্টি আমার নকুড়ের
থেকেও নলিন চন্দ্রের বেশি ভালো। কলকাতার আরও বেশ কিছু নামী অনামী দোকানের ভালো
মিস্টি খেয়েছি, অবশ্য সবাই যে মনে দাগ কেটেছে থুড়ি জিভে স্বাদ টেনেছে তা নয়। তবে
কলকাতার বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে যেটা মিস করি সবথেকে বেশি, তা এই মিস্টি। কোথাও কোথাও
ব্যতিক্রম তো ঘটেই। পুরীর খাজা আর ছানাপোড়ার মতোই বেনারসের রাবড়ি।
মাঝে মাঝে মনে হয় কেন যে মিস্টির এত দাম বাড়ে! আমাদের মতো
সুগারের রুগীকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যই বোধহয়।
পুরীতে শেষদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে স্বর্গদ্বারের কাছে ‘কাকাতুয়া’-র দোকানে খাজা কিনতে গিয়েছিলাম। পৌঁছে দেখি
দোকানের চারপাশে শুধু খাজা খাজা এবং খাজা। সামনেই একটা ছোট ট্রাক ধরণের গাড়ি
দাঁড়িয়ে, তার পেছনের খোলা জায়গায় পেঁটরা পেঁটরা খাজা। আর দোকানের সামনেও বড় বড়
পাত্রে স্তুপীকৃত সদ্য ভেজে আসা খাজা কর্মীদের হাতের নিপুণতায় দ্রুত প্যাকেটবন্দী
হচ্ছে। বুই ব্যস্ত হয়ে পড়ল খাঁচায় কাকাতুয়ার ছবি তুলতে, আমার দৃষ্টি খাজার দিকে। ‘আচ্ছা, অমনি একটু খাওয়া যায় না?’ ভাববাচ্যে বলি আমি। সামনে যে
কর্মচারিটি খাজার প্যাকেট করছিল সে এক মুঠো ভাঙা খাজা তুলে আমার হাতে দেয়। আমরা
তিনজনে ভাগ করে খাই। ফুরালে হাত ধুয়ে আসি। তারপর আবার ভাববাচ্যে বলি, ‘আরেকটু কি পাওয়া যায় না?’ লোকটি আবার একমুঠো ভাঙা খাজা
তুলে দেয়।
পরেরদিন বাড়ি ফিরে কোনও লাগেজ খোলার আগেই খাজার প্যাকেট খুলি
সর্বাগ্রে।
কী মিস্টি এ সকাল...!
No comments:
Post a Comment