আমাদের
দুই ভাইবোনেরই পুরী পুরোপুরি সয়না। দাদার বার দুয়েক ফোন হারিয়েছে, একবার সমুদ্র
ছিনতাই করেছে আর একবার মানুষে। আর আমার ক্ষেত্রে যদিও কিছু হারায়নি, মানে দুবারই
হারাতে হারাতে বেঁচে গেছে একেবারে আক্ষরিক অর্থে, তা হল খোদ আমি। সত্যি বলতে কী
বার বার তিনবার – অর্থাৎ এবারে পুরী যাওয়ার সময় থেকেই আমার মনের খুব গোপনে
একটা গভীর সংশয় ছিল, ফিরব তো? এটা একেবারে শেষদিন সমুদ্র থেকে না ওঠা অবধিই ছিল।
প্রথমবার
পুরী যাই বাবা মায়ের সঙ্গে। তখন ঠিক কোন ক্লাসে পড়ি ইত্যাদি কিছু আর মনে নেই। তবে
একেবারে পুরোনো ডায়েরি দেখলে পাওয়া যাবে। কারণ সেই আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনি লেখার
চেষ্টা যা শেষ হয়েছিল যাওয়ার পথেই। বাবা-মা দুজনেই সাঁতার জানত। আমরা দুজনেই
জানিনা। বাবা আমাদের নিয়ে বেশ কিছুটা গভীরে, যেখানে শেষ কয়েকজন স্নান করছে, সেখানে
নিয়ে চলে যেত। স্মৃতি বলছে, সেখানে জলের ওপর ভেসে থাকতে হলে মাটিতে পা পেতামনা আমি।
কিন্তু ভয় লাগতনা, মনে হত, বাবা তো আছে, এমন কী ডুবে গিয়েও ভয় পাইনি। ওই রকম একটা
জায়গাতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় বাবার হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম। জলটল খেয়েছিলাম কিনা তাও
মনে নেই। বাবা জামা ধরে টেনে তুলেছিল এইটুকু শুধু মনে পড়ে।
দ্বিতীয়বার
পুরী যাই মেয়ের বছর দুয়েক বয়সে। জলে ওর একটুও ভয় নেই এটা সেইবারেই বুঝতে পারি। তখন
আমি চাকরি করতাম। অন্য কারোর ভরসায় ওকে সাঁতারে ভর্তি করতে সাহস পাইনি। সুইমার হয়েছে
অনেক বড় বয়সেই। সে যাইহোক, সে তো জল থেকে উঠবেই না। বুঝিয়েসুঝিয়ে একবার ওকে নুলিয়াদের কাছে বসিয়ে
আমরা দুজনে একটু জলে নেমেছি। খুব ভেতরেও যাইনি। পুরীর সমুদ্রে যেটা সবচেয়ে
অসুবিধার তা হল পায়ের তলার বালি সরে যায়। পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া নিয়ে অনেক
গল্প আছে। কিন্তু পায়ের তলার বালি সরে গেলে যা হয় তা আক্ষরিক অর্থেই পতন। আমার
আবার শুকনো মাটিতেও ধপাধপ আছাড় খাওয়ার একটা বাজে অভ্যেস আছে। যাইহোক, কিছুক্ষণ
বাদেই পায়ের তলার বালিও সরল, সঙ্গে আমার পা-ও। আমি ভাসছি অথবা ডুবছি, যে কোনোটাই
ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ কিনা হাবুডুবু খাচ্ছি। খুবই অল্প সময়েই সব ঘটছিল, যদিও আমার
মনে হয়েছিল অনেকক্ষণ। নাকমুখ দিয়ে জল ঢুকছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, একেবারে যাকে
বলে, খাবি খাচ্ছি। খুব কষ্ট হওয়ার পর একটা সময় সব কেমন শান্ত হয়ে এল, একটা
চেতন-অচেতন আচ্ছন্ন ভাবের মতো। মনে খানিক বৈরাগ্য জাগল কিনা জানিনা, কিন্তু মনে হল
– তাহলে এভাবেই আমি গেলাম!
তারপরে একটুক্ষণ কিছু মনে নেই। খেয়াল হতেই দেখি রত্নদীপ আমাকে টেনে পাড়ের দিকে
নিয়ে আসছে। পাড়ে গামছা, চটি এবং মেয়ে রেখে যাওয়ার জায়গায় কোনোমতে পৌঁছে আমার হাল টের পেলাম – নাক, কান, মুখ সমস্ত জায়গা দিয়ে জল আর বালি বেরোচ্ছে আর
তারসঙ্গে চোখের জল নাকের জল মিলেমিশে সে এক ভয়াবহ অবস্থা। বেশ কিছুটা সময় গেল
ধাতস্থ হতে। তারপরে শুনলাম, খুব বেশি দূরে যাইনি, কিন্তু স্রোতের টানে হাবুডুবু
খাচ্ছিলাম।
এরপর বেশ
কিছুকাল সমুদ্রে যেতে চাইতাম না। আসলে আরও বারদুয়েক আমি মরতে মরতে ফেরত এসেছি বটে,
একবার শ্বাস বন্ধও প্রায় হয়ে এসেছিল। কিন্তু সবমিলিয়ে এই অভিজ্ঞতাটাই সবথেকে
খারাপ।
এবারে
তাই প্রথম থেকেই ঘোর সংশয় ছিল মনে। ভালোয়ভালোয় ফিরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। খামোখা কে আর
সমুদ্রে ডুবে মরতে চায়?