Thursday, March 31, 2016

হারানো

আমাদের দুই ভাইবোনেরই পুরী পুরোপুরি সয়না। দাদার বার দুয়েক ফোন হারিয়েছে, একবার সমুদ্র ছিনতাই করেছে আর একবার মানুষে। আর আমার ক্ষেত্রে যদিও কিছু হারায়নি, মানে দুবারই হারাতে হারাতে বেঁচে গেছে একেবারে আক্ষরিক অর্থে, তা হল খোদ আমি। সত্যি বলতে কী বার বার তিনবার অর্থাৎ এবারে পুরী যাওয়ার সময় থেকেই আমার মনের খুব গোপনে একটা গভীর সংশয় ছিল, ফিরব তো? এটা একেবারে শেষদিন সমুদ্র থেকে না ওঠা অবধিই ছিল।

প্রথমবার পুরী যাই বাবা মায়ের সঙ্গে। তখন ঠিক কোন ক্লাসে পড়ি ইত্যাদি কিছু আর মনে নেই। তবে একেবারে পুরোনো ডায়েরি দেখলে পাওয়া যাবে। কারণ সেই আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনি লেখার চেষ্টা যা শেষ হয়েছিল যাওয়ার পথেই। বাবা-মা দুজনেই সাঁতার জানত। আমরা দুজনেই জানিনা। বাবা আমাদের নিয়ে বেশ কিছুটা গভীরে, যেখানে শেষ কয়েকজন স্নান করছে, সেখানে নিয়ে চলে যেত। স্মৃতি বলছে, সেখানে জলের ওপর ভেসে থাকতে হলে মাটিতে পা পেতামনা আমি। কিন্তু ভয় লাগতনা, মনে হত, বাবা তো আছে, এমন কী ডুবে গিয়েও ভয় পাইনি। ওই রকম একটা জায়গাতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় বাবার হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম। জলটল খেয়েছিলাম কিনা তাও মনে নেই। বাবা জামা ধরে টেনে তুলেছিল এইটুকু শুধু মনে পড়ে।

দ্বিতীয়বার পুরী যাই মেয়ের বছর দুয়েক বয়সে। জলে ওর একটুও ভয় নেই এটা সেইবারেই বুঝতে পারি। তখন আমি চাকরি করতাম। অন্য কারোর ভরসায় ওকে সাঁতারে ভর্তি করতে সাহস পাইনি। সুইমার হয়েছে অনেক বড় বয়সেই। সে যাইহোক, সে তো জল থেকে উঠবেই না। বুঝিয়েসুঝিয়ে একবার ওকে নুলিয়াদের কাছে বসিয়ে আমরা দুজনে একটু জলে নেমেছি। খুব ভেতরেও যাইনি। পুরীর সমুদ্রে যেটা সবচেয়ে অসুবিধার তা হল পায়ের তলার বালি সরে যায়। পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিন্তু পায়ের তলার বালি সরে গেলে যা হয় তা আক্ষরিক অর্থেই পতন। আমার আবার শুকনো মাটিতেও ধপাধপ আছাড় খাওয়ার একটা বাজে অভ্যেস আছে। যাইহোক, কিছুক্ষণ বাদেই পায়ের তলার বালিও সরল, সঙ্গে আমার পা-ও। আমি ভাসছি অথবা ডুবছি, যে কোনোটাই ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ কিনা হাবুডুবু খাচ্ছি। খুবই অল্প সময়েই সব ঘটছিল, যদিও আমার মনে হয়েছিল অনেকক্ষণ। নাকমুখ দিয়ে জল ঢুকছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, একেবারে যাকে বলে, খাবি খাচ্ছি। খুব কষ্ট হওয়ার পর একটা সময় সব কেমন শান্ত হয়ে এল, একটা চেতন-অচেতন আচ্ছন্ন ভাবের মতো। মনে খানিক বৈরাগ্য জাগল কিনা জানিনা, কিন্তু মনে হল তাহলে এভাবেই আমি গেলাম! তারপরে একটুক্ষণ কিছু মনে নেই। খেয়াল হতেই দেখি রত্নদীপ আমাকে টেনে পাড়ের দিকে নিয়ে আসছে। পাড়ে গামছা, চটি এবং মেয়ে রেখে যাওয়ার জায়গায় কোনোমতে পৌঁছে আমার হাল টের পেলাম নাক, কান, মুখ সমস্ত জায়গা দিয়ে জল আর বালি বেরোচ্ছে আর তারসঙ্গে চোখের জল নাকের জল মিলেমিশে সে এক ভয়াবহ অবস্থা। বেশ কিছুটা সময় গেল ধাতস্থ হতে। তারপরে শুনলাম, খুব বেশি দূরে যাইনি, কিন্তু স্রোতের টানে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।

এরপর বেশ কিছুকাল সমুদ্রে যেতে চাইতাম না। আসলে আরও বারদুয়েক আমি মরতে মরতে ফেরত এসেছি বটে, একবার শ্বাস বন্ধও প্রায় হয়ে এসেছিল। কিন্তু সবমিলিয়ে এই অভিজ্ঞতাটাই সবথেকে খারাপ।

এবারে তাই প্রথম থেকেই ঘোর সংশয় ছিল মনে। ভালোয়ভালোয় ফিরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। খামোখা কে আর সমুদ্রে ডুবে মরতে চায়?


মা

উর্জা প্রশ্ন করে, কথা না শুনলে কী হবে? হয় দুষ্টুমি করছিল, নয় খাচ্ছিল না। পিপিয়া বলে, কথা শুনছ না তো, মা সব দেখতে পাবে, বাড়ি ফিরেই দেখবে কী হয়। ভারী আশ্চর্য হয়ে বলে, মা তো এখানে নেই, কী করে দেখবে? পিপিয়া ততোধিক আশ্চর্য হয়ে বলে, ওমা, তুই তাও জানিস না? মায়েদের চারদিকে - সামনে পেছনে,  কাছে দূরে সর্বত্র চোখ থাকে। আমিও তো মা, দিদিয়াকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। শিশু তো, তাই সত্যি কথা কত অনায়াসে বিশ্বাস করে।

একটু আগেই বন্যপ্রাণের সম্পাদককে বলছিলাম যে, এর আগে এইসব লেখা চুরি জাতীয় দু-চারটে যা ছুটকোছাটকা ঘটনা চোখে পড়েছে বা পড়িয়েছে, সেগুলোর কোনটাই এমন বিচ্ছিরিরকমের ছিলনা। যেমন, এক ভূগোলের মাস্টারমশাই তাঁর ওয়েবসাইটে বোধহয় ছাত্রদের বোঝানোর সুবিধার জন্য আমাদের ছুটি-র দু-একটা লেখা রেখেছিলেন, দু-একজন লেখকও আমাদের না জানিয়ে কখনও অন্য জায়গায় একই লেখা প্রকাশ করেছেন এরকম আর কী। এগুলোকে খুব একটা আমরা পাত্তাও দিইনি। নিজেরাই কথা বলে একরকম রফায় এসেছি। কিন্তু তাই বলে পুকুর চুরি হলে তো সর্বসমক্ষে বলতেই হয়। সত্যি আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি, একথা বলেই ফেললাম তাঁকে।

আমাদের ছুটি-র বয়স মাত্র পাঁচ বছর। প্রতি মাসে আমাদের ছুটি-র ওয়েবসাইটের ভিউয়ার সংখ্যা মোটামুটি সাত-আট হাজার। যেমাসে পত্রিকা বেরোয় সেটা দশও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের ছুটি-র ফেসবুক গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ছাব্বিশ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন অনেক অ্যাড রিকোয়েস্ট আসে। পেজের মেম্বার সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই বেশ কিছু লাইক পড়ে। ফলতঃ যেখানেই লেখা না জানিয়ে পুনঃপ্রকাশ হোক, কেউ না কেউ ঠিক জানাবেই। 

আর আমি যে চতুর্দিকে খুব ভালো দেখতে পাই, সে আমার মেয়ে জানে। আমাদের ছুটি তো ওরই কনিষ্ঠ।


আসলে মায়েরা সব জানতে পারে।

আমড়াতলার মোড়ে!


কলেজ স্ট্রিটে যাব বলে বাসে উঠেছি। তাড়া ছিল, তাই আগে সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের বাস আসায় তাতেই। ওই চত্ত্বরটা একসময়ে আমার খুব চষা হলেও এখন কমই যাই।

ভাড়া দেওয়ার সময় কন্ডাক্টরকে বলি, দাদা, কলেজ স্ট্রিট যাব, যেখানটায় সুবিধা নামিয়ে দেবেন।
টিকিটটা হাতে গুঁজে দিয়ে কন্ডাক্টর বলেন, আমি কলুটোলা বলে চিল্লাব, আপনারা উঠে আসবেন।

মাথা নেড়ে ফিসফিস করে মেয়ের কানে বলি, মানে ওর কানে গোঁজা কর্ডটা সরিয়ে, ওরে গানটা একটু পরে শোন, নাহলে চিল্লালে কিচ্ছু শুনতে পাবি না।

এই আজকাল এক মুশকিল, রাস্তায় যে গল্প করতে করতে যাব, তার উপায় নেই মেয়ের আমার কানে কর্ড আর প্রাণে গান। কিছু বলতে গেলে আমাকেই চিল্লাতে হয় আর কি।

মেয়ে নিশ্চিন্ত গলায় বলে, তুমি তো শুনতে পাবে। সে গান শোনে।

দেখতে দেখতে গিরীশ পার্ক আসে, কন্ডাক্টর চিল্লান, গিরীশ পার্ক, গিরীশ পার্ক...। মেয়ের কানের কর্ডে আবার টান দিয়ে বলি, এবারে বন্ধ কর, গিরীশ পার্ক এসে গেছে। এর পরের স্টেশনই মহাত্মা গান্ধী রোড।

গান শোনা না থামিয়েই সে হাসিমুখে জবাব দেয়, তাহলে তো কন্ডাক্টর গিরীশ পার্ক, প্ল্যাটফর্ম বাঁদিকে বলেই চিল্লাতে পারত।

অতএব রামমন্দির পেরোয়। মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশন আসছে দেখে আমি এবং আমরা উঠে নামার তোরজোড় করি। ভাবি এখানে নেমে গলি দিয়ে চলে যাব।

কন্ডাক্টর কিছুতেই নামতে দেননা। বলেন, এখানে না, এখানে না, ওই বইয়ের দোকান যেখানে আছে, সেখানে যাবেন তো, আমি কলুটোলায় নামিয়ে দেব, ওখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট।

বাস এগোয়, কলেজ স্ট্রিট মোড়ের প্যারালাল ক্রসিংও আমার চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যায়। আমি ওই মোড়ের মাথাতেই যাব। কিন্তু কন্ডাক্টর তাঁর কর্ত্তব্যে অটল, কিছুতেই আমাদের নামতে দেবেন না।

অবশেষে কলুটোলা আসে। কন্ডাক্টর চিল্লান, কলুটোলা, কলুটোলা...। আমরাও নেমে পড়ি।

এই রাস্তাটাও আমার চেনাই। সত্যি মিনিট পাঁচেক হেঁটেই কলেজ স্ট্রিট চত্ত্বরে পৌঁছাই। তারপরে মোড়ের দিকে হাঁটা দিই। মানে হাঁটতেই থাকি, হাঁটতেই থাকি, মোড় আর আসেনা।

শেষপর্যন্ত মোড়ে পৌঁছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে বলি, আর কখনও কাউকে কলেজ স্ট্রিটে নামিয়ে দিতে বলব না, তা সে যতই চেল্লাক।


Tuesday, March 29, 2016

খ্যাত!



তবে ‘আমাদের ছুটি’-র সুনাম ছড়িয়েছে মানতেই হয়। নাহলে এমন কাণ্ড হয়! দিনে ডাকাতি!
ভালোদিক দেখতে হয় যে সবকিছুর...

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক



ফেসবুক নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই বিন্দুমাত্র। কিন্তু 'আমাদের ছুটি' আমার আর এক সন্তানের মতো। তার গায়ে আঁচড়টুকু লাগলে আমার সহ্য হয়না।
আজ ভিড় বাসে আসছিলাম। আলাদা বসার জায়গা পেয়েছি। পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে আড়াল করছিলাম যাতে ভিড়ে কেউ কোনও সুযোগ না নেয়।
কী জানি, মন এতো খারাপ আজ যে খেতেও ইচ্ছে করছে না। কাল থেকেই মনখারাপ ছিলই, আজ সত্যিই কিছু কিছু বিষয় নিয়ে খুব খারাপ লেগেছে।
খুব কমদিন তো হল না সাংবাদিকতার জগতকে দেখছি।
এখনও তবু খারাপ লাগে কেন অন্যের ব্যবহারে নিজেকেই প্রশ্ন করি।

যতোবার আলো জ্বালাতে যাই ইত্যাদি...



যতোবার ভাবি মানুষকে বিশ্বাস করব, ততোবারই তার গোড়ায় জল ঢেলে দেয় মানুষই। আমার কাছে মানুষকে বিশ্বাস মানে শিশুর মতো সরলভাবে বিশ্বাস। যেমন বিশ্বাসে সমুদ্রের ঢেউ এলে আমাকে আঁকড়ে ধরছিল উর্জা। যেমন বিশ্বাসে ছোটবেলায় পুরীর সমুদ্রে ভেসে গিয়েও ভয় পাইনি, বিশ্বাস ছিল, বাবা আছে।
 
আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা অদ্ভুত বিষয়ে বিশ্বাস করি, তার পিছনে সত্যি একটা কাহিনি আছে। এই কাহিনিটা আমি কাউকে কাউকে বলেছি। আর তাই সমাপতনে আমি বিশ্বাস করি না। এই কাহিনির বক্তব্য যেটা, তা হল, আমি খুব রাগী, অনেকসময়ে খুব খারাপ ব্যবহারও করে ফেলি রাগের মাথায়, তা সবথেকে ভালো জানে আমার বাড়ির লোকজন। কিন্তু কারোর খারাপ আমি চাই না। কিন্তু কেউ যদি সত্যিই আমার খারাপ চায় বা ইচ্ছে কোরে করে তার ক্ষতি হবে। একথা আমি মন থেকে বিশ্বাস করি। হ্যাঁ, এটাকে যদি খারাপ চাওয়া বলা যায় তাহলে চাই হয়তো। এইটা আমার একমাত্র সুপারস্টিশন বলতে পারি।

Monday, March 28, 2016

চুরিও না ডাকাতি

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে ২৩ মার্চ ২০১৬ এই ৬ মাস ধরে 'উত্তরের সারাদিন'-'আমাদের ছুটি' থেকে লেখা ও তথ্য চুরি নয়, ডাকাতিই বলা ভালো, নিয়মিত চলছিল কাগজটির বুধবারের দশের পাতায়। এর আগে ওই পাতায় যার নিয়মিত লেখা বেরোতো তাঁর নাম ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লোকটি আজ ফোনে যোগাযোগ করেছে। এরপরে 'আমাদের ছুটি'তে প্রকাশিত ভ্রমণকাহিনি এবং তথ্য নিয়মিতভাবে ওই পাতায় বেরোতে শুরু করে। এই তথ্য আমার নিজের লেখা। আমাদের ছুটি প্রকাশের দুবছর আগে থেকে প্রায় সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গার তথ্য আমি লিখেছিলাম। কয়েকটি জায়গার তথ্য বন্ধু সুপ্রতিমের ট্রাভেল ছুটির থেকে নেওয়া, আমিও ওদের কিছু তথ্য সেইসময়ে লিখে দিয়েছিলাম। এরমধ্যে আন্দামানের তথ্যের নীচে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রভাবে আমাদের ছুটির নাম রয়েছে। বাকি তথ্য অন্য কারোর নামে। সম্ভবত এই নামটিও ভুয়ো। এইসময়ে ওই পাতায় আর একজনেরই লেখা নিয়মিত বেরিয়েছে। তার নাম মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য।
 
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের আজ ফোন করে জানিয়েছেন যে তাঁরা ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। এবং যে ওই পাতা দেখে তিনি আজ আসেননি। আমরা কি চাই জানতে চেয়েছেন।

এই বক্তব্যের পুরোটাই আপাদমস্তক মিথ্যে এবং একাধিকজন মিলে ইচ্ছে করে করা হয়েছে, আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।

আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে, কাগজে ভুল সংশোধন করে ক্ষমা চাইতে হবে, ওই লেখাগুলির নাম সহ 'আমাদের ছুটি'-র থেকে প্রকাশিত এবং তথ্য ওই ভুয়ো নামের পরিবর্তে আমার নাম দিতে হবে। এছাড়াও আমাদের ছুটিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই প্রচার ক্যাম্পেন অব্যাহত থাকবে।

আগামীকাল লেখার লিস্ট পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে বলব।

বন্ধুরা, সঙ্গে থাকুন।