গত কদিন
ধরে কয়েকটা দৃশ্য বড্ড মনে পড়ছে। ছোটবেলার কয়েকটা দৃশ্য। কিন্তু আমার কাছে যার
গুরুত্ব আছে, অন্যের কাছে আছে কি? তবু লিখতে ইচ্ছে করছে।
কেন মনে
পড়ছে সেটাই আগে বলি। তারপরে দৃশ্যগুলো।
১) গতকাল
নারী শিক্ষা সমিতিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দিতে দিতে ক্রমশ: খানিক কথা বলতেই শুরু
করলাম। মাথায় ঘুরছে রীতাদির দেওয়া বক্তৃতার বিষয় - নিবেদিতা আর অবলা বসুর সম্পর্ক।
একবছর ধরে পড়ছি তো পড়ছি। নিবেদিতাকে অনেক জানা যায়। যদিও মানুষ নিজের স্বার্থে
কাউকে কাউকে মহামানব বানিয়ে তোলে। আবার অন্যদিকে অবলার প্রায় কিছুই জানা যায় না।
একে তো এই দুই ভয়ানক মুশকিল। তার ওপর জগদীশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এত
সব বড় বড় মানুষদের ভিড়। একটু এদিক ওদিক হয়েছে কী..! কিন্তু সত্যি খোঁজার মধ্যে
ভারী একটা আনন্দ আছে। অনেকটা রহস্য উন্মোচনের আনন্দ। আর আরো ভালো লাগে যখন দেখি
বলার পরে এক দিদি বলে ওঠেন, দময়ন্তী এত ভালো
বলে,
ও বললে ওঠা যায় না। রীতাদিও খুশী হয়ে ওঠেন।
আর আমার
মনে পড়ে একটা বারো-তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়েকে। যে পড়া করে এসেছে। প্রতিদিনই আসে যতই
শরীর খারাপ থাকুক না কেন। তাকে দাঁড় করিয়ে পড়া জিজ্ঞাসা করা হল। তার মুখ দিয়ে
কিছুতেই কথা বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে না।
এমন কী সে যে জানে এটাও না। হাই বেঞ্চে ঘুঁষি মারছে একটা একটা, একটা একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে। শিক্ষিকাদের ধৈর্য কোথায় শোনার? বসে পড় ঠিক আছে। পরের জন উত্তরটা বল। রাগে অপমানে মেয়েটার
মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। নাহ, কোনো বন্ধুও নেই
সাহস যোগানোর...
২) আমি
যে কাজেরই ভাবনার কথা বলি, অধীরদা বলেন, আছি। আমি না বললে তবেই তুমি অন্য কোথাও যাবে। অন্য একটি
বিশেষ সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান থেকেও ফোন আসে, আমার কাজের বাছাই ইংরেজি অনুবাদ হবে।
ভারী
আনন্দ হয়,
কিন্তু ওই আবার মনে পড়ে।
মনে পড়ে
যায় সেই বারো-তেরো- চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়েটার কথা। ভারতবর্ষের ভ এর গোল্লা থেকে
যে কিছুতেই বেরোতে পারছে না, হাতটা কেবল ঘুরে
যাচ্ছে,
ঘুরেই যাচ্ছে। তারপর মাধ্যমিক এসে গেছে। একটানা দশ মিনিটের
বেশি পড়তে পারে না। দশ মিনিট পড়লে, দশ মিনিট বিশ্রাম। খাতার পেছনে রোজ গোটা গোটা করে লেখে, আমাকে পারতেই হবে। ইতিহাস পরীক্ষার দিন। লিখতে লিখতে
যন্ত্রণায় হাত জড়িয়ে আসছে। পাশে রাখা মলম মেখে আবার লেখা। নাহ, তাও একটা প্রশ্ন ছেড়ে দিতেই হল।
কয়েক বছর
পরের কথা। পার্ট ওয়ান চলছে। পরীক্ষার আগেই তেড়ে জ্বর, ম্যালেরিয়া। অলরেডি দু বছর নষ্ট হয়ে গেছে, ড্রপ দেওয়া যাবে না। ওদিকে হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে, দুটো হাতই। ওষুধ, গরম জলের সেঁক। বটানি পাস পরীক্ষা, শেষ করা যাবে না, আর হাত-মাথা
চলছে না। বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসেই অজ্ঞান। অপরিচিত একজন জল ভেবে ও আর এস নিয়েই
চোখে-মুখে ছিটান। ফিজিওলজি পাসের আগের দিন তিনবার ১০৫ জ্বর। তৃতীয়বারে জ্বর নামছে
না। ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে স্থানীয় ডাক্তারেরও হাত কেঁপে যাচ্ছে। জ্বর নামতেই মেয়েটার
মনে হল ফেল করে যাব? পাঁচটা প্রশ্ন
লিখতে হবে। ছটা পড়ে যাই। কী ভাগ্যিস ঠিক ওই ছটাই এসেছিল।
৩) এর
চেয়েও আশ্চর্য প্রস্তাব নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন দুই অধ্যাপক। তাঁদের কথায় তুমি
এমন একটা কাজ একা একা করেছ মা। কী অসম্ভব একটা কাজ করেছ। তোমার জন্য কিছু করতে
পারলে ভীষণ ভালো লাগবে।
মনে
পড়ছিল সেই ছোট মেয়েটাকে আবারো। যত ভালোই পরীক্ষা দিক ভুগোলের দিদিমণি কান ঘেঁষে
পাস করাবে। বাংলা ইংরেজিতে শেষপর্যন্ত অন্য স্কুলে গিয়ে স্কুল টপার হলেও এই
ইস্কুলে কম নম্বর সে পাবেই। কিছুতেই তাকে নম্বর দেওয়া হবে না।
মনে পড়ে
কলেজ শেষের দিকে সে টিউশনি খুঁজছে অথবা চাকরি...। কিচ্ছু পাচ্ছে না। কাউকে চেনেই
না সে। মুখ ফুটে বলা তো দূর। ওদিকে বাবা বলেছে আর পড়াতে পারবে না...
সাংবাদিকতা
করতে এসেও তাই।
মনে পড়ে
যায় একা গবেষণার তিক্ত ঘটনাগুলো।
৪) বছর
দুয়েক আগে হাসপাতালে ভর্তি। হস্টেলের পুরোনো বন্ধুরা খোঁজ নিচ্ছে। ফিরে এলে কুড়ি
বছর পর প্রথম গেট টু গেদারটা বাড়িতেই হল। খোঁজ নিচ্ছে আমাদের ছুটির বন্ধুরা। আবার
এই কয়েকদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। অভিষেক হাজির হল। হাসপাতালেই আলাপ হল আমাদের
ছুটির এই তরুণ লেখক ভ্রাতৃপ্রতিম অভিষেকের সঙ্গে। ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে নিয়মিতই
নতুন পুরোনো বন্ধুরা।
সাদা
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা তেরো বছরের মেয়ের কথা মনে পড়ছিল। ব্রেস্ট টিউমার
অপারেশন হয়ে বাড়িতে দেড়মাস। নাহ, দেখতে আসা তো
দূরের কথা কেউ খোঁজ পর্যন্ত নেয় না। সারাদিনে সব মিলিয়ে ২১টা ওষুধ। দেওয়ালে নিজে
চার্ট বানিয়ে রেখেছে। দেখে দেখে খায় আর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। যে জানলায়
কোনদিনও কোনো দইওলা আসবে না।
আরো দু
বছর পর স্কুলেরই গন্ডগোলে আবার হাসপাতালে। মাধ্যমিকের ঠিক আগে। নাহ, এবারেও খোঁজ নিল না কেউ। খোঁজ নিল যখন এক বছর পর অন্য স্কুল
থেকে মাধ্যমিক পাস করল, তার রেজাল্ট
জানতে চেয়ে সেখানে ফোন গেল পুরোনো স্কুল থেকে।
আজকাল
মনে পড়ে,
বড্ড মনে পড়ে। যখন বিছানা থেকে উঠতে পারি না, ক্লান্ত লাগে, ব্যথা করে সেইসব দিনগুলো মনে পড়ে যখন অনেককিছু সত্ত্বেও হেঁটে চলে বেড়াতাম।
কিন্তু
কাজ তো সবে শুরু করেছি। এখনও অনেকটা পথ বাকি।