মা সুর
বাঁধছে তানপুরায়। হারমোনিয়ামটা আগে বাজিয়ে নিচ্ছে। তানপুরার একেকটা কান ধরে আলতো
মোচড়। একটা শব্দ তারপর তারের আওয়াজ। না, ঠিক লাগছে না, মাথা নাড়ছে না
বাচকে,
তারপর তানপুরার লাউয়ের খোলার ওপরে আটকানো কড়িগুলো আলতো করে
এগোচ্ছে,
পেছোচ্ছে। চুপ করে বসে দেখছি। মাথায় আঁকছি হয়ত ছবিটা। অথবা
দুষ্টুমি করে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছি হারমোনিয়ামের পেছনের কাপড় লাগানো গোল গোল
ফুটোগুলোয়। উলটোদিকের বেলোটা খুলে দিচ্ছি কখনও। মা বারণ করছে সুর বাঁধতে বাঁধতে।
আর আমি ভাবছি কখন ওই হলুদ তারটা বাঁধা হবে আর টঙ করে আওয়াজটা কানে আসবে। ওটা আমার
খুব প্রিয়। তারপরে মা হয়ত আমাকে বাজাতে দেবে তানপুরাটা। নিজে হারমোনিয়ামটা নেবে।
অথবা শুধু তানপুরা বাজিয়েই গান হবে, মা-ই বাজাবে হয়ত। আমি তো সুর শুনে খালি গলায় তুলে নিতে পারি যখন তখন, কিন্তু বাজনায় রপ্ত করতে কঠিন লাগে। সেপটিক টনসিল বারবার।
পরীক্ষক বলেছিলেন, গাইলে একমাত্র
এই মেয়েটারই হবে।
'বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে...'
মা
দোতলায় গান শেখাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। ওরা কেউ তুলতে পারছে না। কতবার ভেঙে ভেঙে
শেখাচ্ছে মা - 'তোদের রথের চাকার সুরে আমার সাড়া
পাইনি গো পাইনি...।' সিঁড়ির নীচে
দাঁড়িয়ে গাইছি মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, 'তরীতে পা দিইনি, আমি পাড়ের পানে
যাইনি গো যাইনি...।'
বৃষ্টি
পড়ছে বাইরে। 'আমার নিশীথ রাতের বাদলধারা...' আর অন্ধকারের অন্তরধন আমার প্রাণমন ঢেকে দিচ্ছে। আমার চোখে
জল - 'আমি চাইনে তপন, চাইনে তারা...।'
মীরার
ভজন গাইছে মা, ' চাকর রহসু বাগ লাগাসু, নিশদিন দরশন পাসু, বৃন্দাবন কী কুঞ্জবনমে তেরে লীলা গাসু' - আর আমি দেখতে পাচ্ছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনির মতো মীরা চাবির গোছাটা সেই রাজপুত
প্রেমিকের হাতে তুলে দিচ্ছে - প্রেম না করলরে, বিনা প্রেমসে, প্রেম না মিলল
রে। ওই তো পথে নেমে গেল মীরা। মায়ের গলায় ভেসে আসছে - 'তাত মাত বন্ধু ভ্রাত আপনান কোঈ...'। ওদিকে কবীরের সুর শুনছি - 'মন মোহি গঙ্গা মন মোহি যমুনা, মন মোহি ধ্যান
করে...।'
ঈশ্বর মিলেমিশে যাচ্ছেন না ঈশ্বরের সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে। জন হেনরির সুরেও তখন তাঁকেই শোনা যায়।
খুব
মনখারাপ মনখারাপ। স্কুলে বড্ড কষ্ট। শরীরও খুব খারাপ। আর লড়তে পারছি না। মা গান
শেখাচ্ছে,
'জানে গুণি গুণকো নিরগুণ কেয়া জানে, জানে বলি বল কো, নিরবল কেয়া জানে?' সত্যিই তো ওরা
কী জানে কেমন করে ভারতবর্ষের 'ভ'-এর থেকে বেরোনো যায় না। আমার হাত গোল্লাটায় ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে, এবারে ঠিক তুলে পরের অক্ষরটা লিখতে পারব, ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে...'জানে হরি বল গজ
মুশক কেয়া জানে...'
No comments:
Post a Comment