রান্নায় আমি প্রায় দ্রৌপদীর মতোই নির্ভীক। দূর্বাসা তো কোন ছাড়, আমার সতেরো বছরের মেয়ের রাগেরও পরোয়া করিনা।
ভূমিকা -
স্কুল
থেকে ফিরেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, আজ কী খেয়ে পড়তে যাব?’
দরজা
খুলে দিয়ে এসেই আবার বিছানায় কাত হয়েছিলেন জননী। তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন, গতকাল
দুধ-কর্নফ্লেক্স খেয়েছে, অতএব আজ নৈব নৈব চ। কতদিন আর ম্যাগি অফার করা যায়? আধখোলা
চোখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক’টায় বেরোবি?’ মেয়ের বিরক্ত গলায় উত্তর (জানে, তবু আবার বলে কেন, মাকে
নিয়ে পারা যায় না), ‘সাড়ে সাতটার ব্যাচে পড়ব, যেমন যাই সাড়ে ছ’টা, পৌনে সাতটা।’ ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে
জননী বলেন, ‘তা সুজি খাবি? করব? (সুজি করতে তিনিও যে বিশেষ আগ্রহী তা
নয়) না, বরং তোর সঙ্গে বেরিয়ে বাইরে কিছু কিনে দেব’খন।’ উদাস গলায় উত্তর আসে, ‘তোমার যা ইচ্ছে, আমি আর কী
বলব (অর্থাৎ, কোনটাই বিশেষ মনঃপুত হল না)।’ একটু ভেবে নিতেই জননীর মাথায় দি আইডিয়া – ‘পুডিং খাবি? অনেকদিন করিনি। দাঁড়া আর পাঁচ
মিনিট গড়িয়ে নিই, উঠছি, ও আর কতক্ষণ লাগবে।’ মেয়ে ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায় রেডি হতে।
রঙ্গমঞ্চ –
প্রথম অঙ্ক
ফ্রিজে
দুধ আছে, চকলেট স্প্রেড আছে (হুঁ, এইজন্যই তো বুদ্ধি করে এনে রাখি কাজে লেগে যায়
কখন), বিস্কুট তো আছেই পাঁউরুটি না থাক, চিনি, সুগার ফ্রি, মাখন কিচ্ছুর কমতি নেই।
ম্যয় গতবারে আনা স্ট্রবেরি টপিংসও আছে (আমাকে আর পায় কে)!
দ্বিতীয় অঙ্ক
মিক্সিতে
মনের আনন্দে ঢালি – দুধ, চকলেট, বিস্কুট, চিনি, সুগার ফ্রি (জননীর
নিজেরই ডায়াবেটিস)। ব্যস, এবার শুধু ডিম ভেঙে দিয়ে চালিয়ে দিলেই হবে। গুনগুন করে
সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ফ্রিজ খুলে ডিমের শূন্যস্থানের দিকে তাকিয়ে এবার নিজেরই ফ্রিজ
হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়।
তৃতীয় অঙ্ক
প্রাথমিক
আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে (মানে অনেককিছু নেই ইনফরমেশনের মধ্যে ডিম ছিল না) মা
জননী এবার মেয়ের ঘরে গিয়ে বিগলিত গলায় বলেন,’বাবু, একটাও ডিম নেই, প্লিজ,
একটু এনে দিবি, দেখ না, সব রেডি করে ফেলেছি।’ বিষম
বিরক্ত গলায় বাবুর উত্তর, ‘কোথায় ডিম পাব এখন? এখানে কোনও দোকানে ডিম রাখেনা, আর এখন
কোনও দোকান খোলেনিও।’ জননী সুর আরও নরম করেন, (তিনি জানেন যে দোকানে
যাওয়ার নামে এমনিতেই বাবুর গায়ে জ্বর আসে) ‘কেন, বাবা যে বলেছিল, ডানদিকের মুদির দোকানটায়
সব পাওয়া যায়।’ বিরক্ত গলায় কন্যার উত্তর, ‘এখন ওটা খোলে না, সেদিন আমি
যখন পড়তে যাচ্ছিলাম, তখন সবে খুলছিল।’ তাহলে একবার না হয় বাজারের ওই দোকানটায় যা, ওই
যে মুদির দোকানের উলটোদিকে, ওটায় ডিম-দুধ রাখে।’ জননী
নাছোড়বান্দা। বাবুর
কন্ঠস্বর ক্রমশঃ উচ্চমার্গে উঠছে, ‘ওটা কতটা দূরে জানো? আরেকটু এগিয়ে রাস্তাটা বাঁকলেই
তেঁতুলতলা। শনিবার বাবার সঙ্গে আসছিলাম, বাবা অন্য দোকানে ঢুকেছিল, আমাকে বলল, তুই
ডিম আর দুধটা কিনে নে। কতক্ষণ লাগবে জানো? যেতে আসতেই পনেরো পনেরো মানে আধঘন্টা,
সোয়া ছ’টা বেজেই যাবে, আমার আজ আর খাওয়া হবে না (শেষটা কিঞ্চিৎ কাঁপা কাঁপা গলায়)।’ জননীর
বেপরোয়া উত্তর, ‘দূর, আমি কতবার ওখান থেকে ডিম আর দুধ এনেছি, ও তো একেবারে
বাজারের সামনেই, দশ মিনিট লাগবে তোর, যা না, বাবা, প্লিজ, রেডি তো হয়েই গেছিস। আমি
এদিকে সব ঢেলে দিয়ে বসে আছি, কথা বলে তো আরও দেরি করছিস।’
অতএব, ব্যাজার মুখে কন্যার গমন।
চতুর্থ অঙ্ক
হঠাৎ কী
মনে পড়ায় জননীর ফোন, ‘তোর আগের সেই ভূগোল স্যারের বাড়ির নীচের দোকানটায় দুধ-ডিম
সব রাখত, যাওয়ার সময় গলিটায় একবার উঁকি দিয়ে যাস তো মা।’ বিরক্ত
গলায় উত্তর আসে, ‘হুঁ’।
ইতিমধ্যে
মা ফ্রিজের সর্বত্র এবং রান্নাঘরের আনাচে-কানাচে দেখে নিয়েছেন কোথাও ডিমের ‘ড’ পর্যন্ত নেই। আসলে কিছুদিন
আগে একবার অদ্ভুত জায়গা থেকে চারটে ডিম বেশ রহস্যজনকভাবেই আবিস্কৃত হয়েছিল। কিন্তু
সে তো অন্য গল্প।
একটু
পরেই মায়ের ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে মেয়ের নাম দেখে জননী কেটে দিয়ে ফোন করেন। কারণ
ওইটেই নিয়ম – ‘আমার ব্যালেন্স কমাবে না’। ওপাশে কিঞ্চিৎ বিরক্ত
কন্ঠ, ‘সব দোকান বন্ধ মা, সঅঅব, স্যারের গলির দোকানও। আমি বাজার পেরিয়ে অনেকটা এসেছি।
স্রেফ মুদির দোকানটা খোলা।’ জননী জানেন বৃথা আশা, তবু নিরুপায় গলায় বলেন, ‘একবার জিজ্ঞাসা করে দেখনা।’ (মা-কে
নিয়ে আর পারা যায় না গোছের কন্ঠে) ‘দেখছি, আচ্ছা।’ একটু পরেই পুনরায় মায়ের ফোন, ‘হ্যাঁ রে, পাসনি তো?’ মেয়ের জবাব, ‘না’ (আমি তো বলেইছিলাম, তুমি
বেকার খাটালে গোছের কন্ঠে)। মায়ের তীব্র আশ্বাস, ‘চলে আয়, লাগবে না, কোনদিন
এগলেস পুডিং বানাইনি বটে, তবে বানিয়ে ফেলব, চিন্তা করিস না।’
পঞ্চম
অঙ্ক
(যেটা
কিনা সেই পুডিং খেতে খেতেই লিখিত এবং এটাই সবচেয়ে সিরিয়াস অধ্যায়)
ফ্রিজ
খুলে আগেই চোখে পড়েছিল, কাস্টার্ড পাউডার আছে। ভয় কী? স্ট্রবেরি কাস্টার্ড। মানে
টপিংসের গল্প বাদ। দূর বাবা, এখন খাবার মতো জায়গায় পৌঁছলেই বাঁচি। বেশ অনেকটা
কাস্টার্ড পাউডার দিয়ে মিক্সি চলল। বন্ধ করে চামচে করে তুলে টেস্ট। এ বাবা চকলেট
কোথায়, এ তো পুরো স্ট্রবেরি পুডিং হয়ে গেছে! আরেকটু চকলেট ঢালি। আরও দুটো
বিস্কুটও, সাবধানের মার নেই কিনা। মিক্সি চালানোর ফাঁকে ফাঁকেই মাইক্রোওয়েভের
কাচের পাত্রে মাখন মাখিয়ে তলায় চিনি ছড়িয়ে চালিয়ে দিই। আরে ক্যারামেলটা করতে হবে
না?
ক্যারামেল
হয়ে গেলে তার ওপরে মিশ্রণটা ঢেলে দিই। আরে জমবেই। পাখাটা চালিয়ে ছোট মোড়া চেয়ারটা
টেনে নিয়ে বসে পড়ি সামনে। মাইক্রোওয়েভ চলতে থাকে। যার স্টার্ট আর পজ বাটন ছাড়া আর
কোনও বাটনই কাজ করেনা এখন। তাতে আর ঘাবড়াচ্ছে কে? স্টার্ট দিলে তিরিশ সেকেন্ড।
এরপর তুমি যত মিনিট চাও সেভাবে বারংবার টিপতে টিপতে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছবে। আরে এতেই
তো ভাতও হয়ে যাচ্ছে এমন কী ভাপা মাছও। চলুক না যতক্ষণ শ্বাস।
মিনিট
তিনেক পরে বন্ধ হলে কাঁটা চামচ ডুবিয়ে দেখি – নাহ্, এখনও টলমল করছে। আবার মিনিট তিনেক।
ওই রে,
দেড় মিনিট হতে না হতে, স্পষ্ট দেখেছি, বিনা চশমাতেই, মাইক্রোওয়েভের কাচের ফাঁক
দিয়ে ওই উপচাচ্ছে, উপচাচ্ছে, উপচাচ্ছে (কেলো, এটা কিন্তু একদম মনে মনে)। সঙ্গে
সঙ্গে তাকে থামাই। খুলি, নামাই। নাহ্, জমেনি। আরে জমেনি তো বোঝাই যাচ্ছে, নাহলে
আর উপচানোর চেষ্টা করবে কেন? কিন্তু উপায় কী? মরিয়া হয়ে আবার বসিয়ে দিই। মিনিট দুই
– যা হবার তা হবে...।
দেখলাম।
নিরুপায় হয়ে দেখলাম, বেশ কিছুটা উপচিয়ে তবে সে শান্ত হল। এবং সান্দ্র হয়েছে। মানে
জমে যাবে অদূর ভবিষ্যতেই। কিন্তু আপাত-ভবিষ্যতের খুব বেশি দেরি নেই। মেয়ের আন্দাজে
একটা বাটিতে কেটে নিয়ে মাইক্রোওয়েভের প্লেটটা মুছে আবার চালিয়ে দিই মিনিট দুই।
এবার ওকে নিয়ে একটু আস্তে ধীরে ভাবলেই চলবে। মেয়ের গরম বাটিটা সোজা ডিপ ফ্রিজে
চালান দিয়ে আবার ওর ঘরে উঁকি মারি।
মোবাইল
নিয়ে সে ব্যস্ত যথারীতি। ঘড়ি দেখি। ছ’টা কুড়ি। নিজেকেই বাহবা দিই, প্রগ্রেস বেশ ভালো। সবিনয়ে
বলি, ‘হয়েই গেছে রে, ঠান্ডা করতে দিয়েছি। মিনিট পাঁচেক থাকুক। এই ধর সাড়ে ছ’টা।’ ‘সাড়ে ছ’টা? সাড়ে ছ’টায় তো আমি বেরিয়েই যাব’, রীতিমতো হুমকি ভেসে আসে।
যদিও আশু বেরোনোর বিন্দুমাত্র কোনও লক্ষণ তার সর্বাঙ্গে নজরে পড়ে না আমার। তবু ফের
মোলাম গলায় বলি, ‘তুই সাড়ে ছ’টা, পৌনে সাতটা বলছিলি না? ওই ধর পৌনে সাতটাতেই গেলি নাহয়
আজ, পৌঁছে যাবি ঠিক। আরে একটু ঠান্ডা নাহলে কী খেতে ভালো লাগবে?’
ডিপ
ফ্রিজ খুলে একবার উঁকি মারি – দূর যেমন গরম তেমনি গরম। মেয়ের হুমকিতে আর চেয়ারে বসার
স্থৈর্য থাকে না। ফ্রিজের সামনে কোমরে হাত দিয়ে রণরঙ্গিনীর ভঙ্গীতে দাঁড়াই। হুঃ,
মানুষ হলে কবেই ঠান্ডা হয়ে যেত, আর এ তো নতুন ফ্রিজ। খানিকবাদে স্রেফ মরিয়া হয়েই
বের করে ফেলি। যাইহোক ভবিষ্যত বড় নিকটবর্তী। যথেষ্ট পরিমাণ কাজু-কিসমিশ দিই, মানে
কিঞ্চিৎ বেশিই আর কী। তারপর প্রায় বুক ঠুকে মেয়ের সামনে প্লেটের ওপর বাটি নিয়ে
দাঁড়াই –‘দেখ হয়ে তো গেল, জমেও গেছে। তুই শুধু শুধু টেনশন বাড়িয়ে
দিস। তবে কতটা ঠান্ডা আর কতটা গরম তা ঠিক বলতে পারব না।’
মেয়ে
হাসিমুখে হাত বাড়ায় (হেবি মুডে আছে, বাব্বা বেঁচেছি)। খেয়েদেয়ে জোর গলায় জানান
দিল, ‘ইস্, মা, ছ’টা পঞ্চাশ হয়ে গেছে। জননীর মুডও এখন স্টেবল –‘ও তো নিজেই দেরি
করলি, ওইটুকু পুডিং খেতে কারও কুড়ি মিনিট লাগে? আমি কিন্তু একদম সাড়ে ছ’টায় দিয়েছি। যা, রিকসা করে
চলে যাস বাসস্ট্যান্ডে।‘ মেয়ে এবার জানায়, ‘ভালোই হয়েছে মা, ডিম যে দাওনি, বোঝাই যাচ্ছে
না।’ মায়ের মুখে একগাল হাসি, ‘চলবে বলছিস তাহলে?’
শেষ অঙ্ক
ইতিমধ্যে
মেয়ের বাবার কাছে মোবাইলে মেসেজ গেছে, দুধ, ডিম ইত্যাদি ইত্যাদি। মেট্রো স্টেশন
থেকে বেরিয়ে তিনি ফোন করলে মেয়ের মায়ের আবার ক্যালকুলেশন শুরু হয়ে যায়। ঝটপট
মাইক্রোওয়েভ থেকে বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত পুডিং। বাহ্, একেবারেই জমে গেছে। সত্যিই
তাই। ক্যারামেলের দিকটাকে ওপরে আনার জন্য যখন উলটাই তখনও সে একেবারেই অনড়। আরে
দূর, চকলেট পুডিং-এ আর ক্যারামেল কী দেখা যাবে? আর খাব তো সেই আমরাই। সোজা ফ্রিজে
চালান দিই। ডিপে নয় প্রথমে অল্প ঠান্ডায়। শেষে কাচের বাটিটা ভেঙে আরেক কাণ্ড হোক
আর কী।
এবার
মনের আনন্দে লিখতে বসি। সাধে কী আর মা বলত, অঘটনঘটনপটিয়সী। জমিয়েছি তো বিনা
ডিমেই এক্কেবারে।
লিখতে
লিখতেই বেল বাজে। দরজা খুলি। ফ্রিজ থেকে সরবত বের করে দিতে দিতেই টপ করে পুডিং-এর
বাটিকে এবার ডিপে চালান দিই। আবার যে ভবিষ্যত নিকটবর্তী।
খানিক
অপেক্ষা করে ঈষদুষ্ণ পুডিং-ই কাজু-কিসমিশ সাজিয়ে দিই। হ্যাঁ, সক্কলকে ওপরের
সান্দ্র অংশটা দিয়েছি। নীচের কঠিন অংশটা নিজের জন্য। কে যেচে খারাপটা দেয়? একেই
আমি যাই ধরে দিই মুখে তাই দুজনেই বলে দারুণ। সেটা বলারও তো কিছু যুক্তি থাকা
দরকার।
তবে
নিজেও খেয়ে দেখেছি, খারাপ বলে কার সাধ্যি?
রাত্তিরে
খেয়ে উঠে ডেজার্ট হিসেবে দিব্বি আবার ঠান্ডা ঠান্ডা পুডিং খাওয়া যাবে।
ওই যে সব
ভালো যার শেষ ভালো। হতেই হবে। আম্মো বানিয়েছি কিনা।
No comments:
Post a Comment