কালিম্পং-এ
ঠাকুর পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত তিনটি বাড়ি আছে - মর্গান হাউস, গৌরীপুর হাউস আর চিত্রভানু। এরমধ্যে মর্গান হাউস ও গৌরীপুর
হাউসে রবি ঠাকুর থেকেছেন পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে। চিত্রভানু প্রতিমা দেবীর
বাড়ি (আনন্দবাজার যতই এটাকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া রথীন্দ্রনাথের বাড়ি বলে প্রচার করুক না কেন)। চিত্রভানুর নির্মাণের সময় নামের নীচেই লেখা আছে - ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০ বা ৮ আগস্ট, ১৯৪৩।
তিনটি
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যেটা মনে দাগ কেটেছে তা হল জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা
গৌরীপুর হাউস। ১৩৪৫ সালের ২৫ বৈশাখ কবি এখান থেকে দূরভাষে আকাশবাণীতে 'জন্মদিন' কবিতাটি পাঠ
করেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার জন্ম এই বাড়িতে। চিঠিপত্রও রয়েছে এই ঠিকানায়
নামাঙ্কিত। এতসব স্মৃতিবিজড়িত।
বাড়িটা
সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাইট সিয়িং এর তালিকায় না থাকায় ড্রাইভার গাঁইগুঁই
করবেন হয়তো। এটা দূরপিনদাঁড়া ভিউ পয়েন্টের দিকে যেতে ক্রকেটি হাউসের (এখানে একসময়
খ্যাতনামা রাশিয়ান শিল্পী নিকোলাস রোয়েরিখের স্ত্রী হেলেনা রোয়েরিখ পুত্র ইউরিকে
নিয়ে বসবাস করতেন। লেখিকা হেলেনা এখানেই মারা যান) একেবারে গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা
নেমে গেছে সেই পথে কয়েক পাক নীচের দিকে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। ওপর থেকেই বাড়িটির
জরাজীর্ণ টিনের ছাদ, ফায়ার প্লেসের
ধোঁয়ার নল চোখে পড়ে। তবে নীচে নেমে অতি কষ্টে বাড়ির সামনে পৌঁছলে মনখারাপ হয়ে যায়।
একে তো
বাড়িটির সংরক্ষণের কোনো চেষ্টা আদৌ হয়নি। তার ওপর সম্প্রতি বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকে
একটি পলিটেকনিক তৈরি হচ্ছে। তারই মিস্ত্রীরা বাড়িটাকে থাকার জন্য আর জিনিসপত্র
রাখায় ব্যবহার করছে। আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে বলে একটা নোটিসও লটকিয়ে দেওয়া আছে।
বাড়ির সামনে খোয়া আর বালির পাহাড়। এদিকে ওদিকে আরও জিনিস, জামাকাপড়। একটা বাদে বাকি সব দরজায় তালা দেওয়া। সেও বুঝলাম
ওদেরই দেওয়া। দোতলার বারান্দায় শাড়ি ঝুলছে যে।
খোয়ার
পাহাড় পেরিয়ে একমাত্র খোলা ফাঁকা ঘরে ঢুকি। পুরোনো দিনের ফায়ারপ্লেসটুকুই যা আছে।
অন্য ঘরগুলোর দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মিস্ত্রিদের জিনিসই চোখে পড়ে।
ফেরার
পথে রাস্তা দিয়ে দোতলার লেভেল সমান উঠে এসে আবার ইটপাথর পেরিয়ে শর্টকাটে দোতলার
জীর্ণ বারান্দায় ঢোকার একটা চেষ্টা করতে গিয়ে মেয়ে আর তার বাবার কাছে কী
ছেলেমানুষি হচ্ছে বলে বকুনি খেয়ে খান্ত দিই অবশেষে।
এর আগে
গিয়েছিলাম মর্গান হাউস। তিনটি বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে মেনটেনড। কারণটা সকলেই জানেন, এটি সরকারি লজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ভাড়াও ভয়ানক বেশি।
বাইরে মুখ্যমন্ত্রীর চেনা হাসিমুখ ছবি। ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে হয় না। বাইরে থেকেই
দেখি। অথচ ইচ্ছে ছিল খুব। কোথায় রবিমামা বসে নানাকিছু পড়ে শোনাতেন, লিখেছিলেন সরলা। স্বর্ণকুমারীর লেখাতেও এই বাড়ির উল্লেখ
আছে। সেইসব স্মৃতিবিজড়িত। কিন্তু... দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
পাইন ভিউ
নার্সারির ঠিক বিপরীতে প্রতিমা দেবীর বাড়িটির ঠিক কী অবস্থা বলব ভেবে পাচ্ছি না।
সেই টিনের চাল আর ফায়ারপ্লেসের নলওলা কান্ট্রি হাউসের মতো চমৎকার দেখতে বাড়িটা। চিত্রভানুর সামনের অংশে আর্ট ও ক্রাফট সেন্টার। ওয়েল মেনটেনড মনে হল। ফুলগাছে ভরা বাগান। তবে বাড়ির ভেতর ঢোকা নিষেধ। অফিসঘর। একপাশে প্রতিমাদেবীর একটা ছবি ঝুলছে বটে। দেওয়ালে লাগানো ম্যাটগুলোও পুরোনো আমলের বলে মালুম হল। ওইটুকুই যা স্মৃতিবিজড়িত আর কী। বাড়ির পেছনের অংশে একটি নোটিস
লটকানো - ভূমিকম্পের পর থেকে দর্শকদের ঢোকা বারণ হয়েছে। ওপরে তাকিয়ে দেখি ভেঙে পড়া
দোতলার দেওয়ালের গায়ে গাছ গজিয়েছে, ভেতরে যেটুকু চোখ যায় হাল ভালো না। ছাদেও গাছ গজিয়েছে। এই অংশটা সারানো হল না
কেন কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।
ফেরার
পথে মংপুতে। কেমন আছে আর এক স্মৃতিবিজড়িত?
সারানো হচ্ছে। কিন্তু কেন একেবারে আগাপাশতলা সারাচ্ছে তা বুঝলাম না। ২০১৬ সালের ছবি
দেখলাম ড্রাইভারের ক্যামেরায়। ভাঙাচোরা কিছু তো চোখে পড়ল না। যাইহোক। তবে গৌরীপুর হাউস আর প্রতিমা দেবীর বাড়ির ভাঙা অংশ সারানোটা জরুরি ছিল বরং।
No comments:
Post a Comment